শিল্প - সাহিত্য

যানবাহনে দুর্ঘটনা পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি ঘটে থাকে। উন্নত বিশ্বেও ঘটে। তবে বাংলাদেশে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে তার পুরোটাই অসাবধানতা এবং নিয়ম না মানার কারণে ঘটে। আর প্রতিবার এর শিকার হয় সাধারণ মানুষগুলো। এবারও তার ব্যাতিক্রম নয়। 

লঞ্চের অগ্নিকাণ্ডে জীবন গেলে প্রায় ৪১ জন নিরীহ মানুষের। আরো শতখানেক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে হয়তো কোন রকমে বেঁচে আছে। জীবনের বাকিটা সময় হয়ত বেঁচে থাকবে বিকলাঙ্গ হয়ে।

প্রাথমিক খবরে জানা গেল, লঞ্চটির ফিটনেস রয়েছে ২০২২ পর্যন্ত। কিন্তু নিউজ পেপারে ঘটনার বিবরণ পড়ে বোঝা গেল লঞ্চটিতে সেইফটি লেভেল ছিল শূন্যের ঘরে! লঞ্চটি কোনভাবেই নিরাপদ ছিল না।

লঞ্চের নিচতলার ইঞ্জিন রুমে রাখা ছিল প্রায় পনেরো বিশ ব্যারেল ডিজেল। যেখানে ইঞ্জিন চলে সেই একই ঘরে কিভাবে এতো পরিমাণ অত্যন্ত দাহ্য ডিজেল রাখা হয়? এভাবেই কি অন্য সব লঞ্চে ডিজেল রাখা হচ্ছে? তারপর ইঞ্জিন রুমের পাশেই ছিল কিচেন, যেখানে ব্যবহার করা হচ্ছিল সিলিন্ডার গ্যাস। ওই গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত।

এতবড় একটি লঞ্চের পাশাপাশি দুইটি রুমে ইঞ্জিন, ২০ ব্যারেল ডিজেল আর অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডার, আগুন তো লাগবেই।

এখন কথা হচ্ছে, সেইফটি অফিসার কিভাবে এই ধরনের অবকাঠামোগত ব্যবস্থার ছাড়পত্র দেয়? পৃথিবীর কোনো দেশেই এই ধরনের ব্যবস্থাকে সেইফ বা নিরাপদ বলবে না। এর ফলে কোনো ছাড়পত্রও দিবে না। 

তেলের ব্যারেলগুলো খুব সহজেই রাখা যেত কিচেন থেকে দূরে একটি ফায়ারপ্রুফ কক্ষে।

খবরে জানা গেছে, আগুন নিচতলা থেকে ছড়িয়ে পড়ে ২য়তলায়। সেখানকার চায়ের দোকানে ছিল আরেকটি গ্যাস সিলিন্ডার। সেটারও বিস্ফোরণ ঘটে এবং ২য়তলায়ও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। 

আর এই আগুন নিয়ে লঞ্চটি চলতে থাকে। কি বিভৎস এক অবস্থা! লঞ্চে কি আদৌ কোনো ফায়ার এলার্ম ছিল? ইঞ্জিন রুমে থাকার কথা বেশ কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার। সেগুলোর কি কোন ব্যবহার হয়েছে? লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের দায়িত্বে থাকা লোকটির কি যথাযথ অগ্নিনির্বাপনের ট্রেইনিং দেওয়া আছে?

আমার ধারণা এগুলোর কিছুই নেই। অন্যান্য লঞ্চেও হয়তো একই অবস্থা। তারপরও দেখা যাবে সব লঞ্চেরই হয়তো ফিটনেস রয়েছে! এ ধরনের ফিটনেসের কোনো ভ্যালু নেই। যেখানে সেইফটি কনসার্ন রয়েছে সেখানে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, যানটি ফিট।

গত ২৩ ডিসেম্বর লঞ্চে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো তা কোনোভাবেই নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটা অব্যবস্থাপনার এক চেইন অব ইভেন্ট। এগুলোর সুরাহা না করলে এ রকম ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটবে। মাঝখান থেকে জীবন যাবে নিরীহ মানুষের।

একজন ছাত্র উপজেলায় ফাঁকি দেওয়া বা কাজ না করে বেতন নেওয়ার নিয়ত করে মেডিকেলে ভর্তি হয় না। পাস করার পর নিরেট এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। তৃণমূলে কোয়াক। উপরে অধ্যাপক। মাঝখানে এমবিবিএস চিকিৎসকের অমানুষিক পরিশ্রমের পরও কোনো অবস্থান নাই। তাকে জনগণের সংস্পর্শে যেতেই সম্পূর্ণ অরক্ষিত এক শ্বাপদ সংকুল জনপদে। কিছুটা রেহাই চাইলে করতে হবে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন, সে আরেক অমানবিক পরিশ্রম। তখন উপজেলা বা গ্রামের চাকরিতে ন্যূনতম সময় দিয়ে শুরু হয় সেই কোর্স, তখন পড়াশোনাই তার লক্ষ্য হয়ে যায়।

কনসালটেন্ট হয়ে গেলে আবার আরেক সমস্যা। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। ভালো প্রতিষ্ঠান নেই। পড়াশোনা অনুযায়ী মূল্যায়ন নেই। বারো বছর একই পদে। আস্তে আস্তে আন্তরিকতা নষ্ট হতে থাকে। ঢাকায় পরিবারের পিছুটান। তারসাথে গৌণ ফ্যাক্টর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শিথিল নজরদারি। এসবের জন্য ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও সবার জন্য সমান সুযোগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমি উপজেলায় কর্মরত থাকা অবস্থায় একবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ডিরেক্টর আমাদের উপজেলায় যান। আমরা সুষ্ঠু ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও উপজেলা পর্যায়ে আবাসন ও নিরাপত্তার কিছু প্রস্তাব তৈরি করে প্রস্তুতি নিলাম।

মহাপরিচালক মহোদয় ঢুকেই একদিক থেকে ধমকাধমকি শুরু করলেন। আবার ধমকাধমকি দিয়েই শেষ করলেন। আমাদের প্রস্তাব, আমাদের মনেই রইল। অথচ আমি যে, ছয় বছর এই উপজেলায় ছিলাম। একজন চিকিৎসকের নামে কোনো অভিযোগ আসেনি। একটাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কোনো কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) শুধু মানুষ হিসেবে নয়, প্রশাসক হিসেবেও ছিলেন অনন্য। তাঁর মাঝে স্থানীয় সংসদ সদস্য জনসভা করে চিকিৎসকদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলেন। কিছুদিন পর আবার আমাদের ডেকে বললেন, ‘আপনারা কিছু মনে করবেন না। জনগণকে উদ্দীপ্ত করার জন্য মাঠে-ঘাটে আমাদের অনেক কথা বলতে হয়।’

অনেক সময় গেছে। তবে প্রভাবশালীরা একই নীতিতে রয়ে গেছে এখনো, (কেউ আবার মাঝখান দিয়া অন্য কিছু মনে কইরেন না।) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কী করা যায়?

ক. পদোন্নতির জন্য পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিতে হবে।

খ. সর্বোচ্চ তিন বছরের মধ্যে চিকিৎসকদের বদলি করে পর্যায়ক্রমে উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজে পদায়ন করতে হবে। চাকরি জীবনের বারো বছরের মধ্যেই অন্তত তিন বছর যেন মেডিকেল কলেজে কাটে।

গ. প্রত্যেক স্বাস্থ্যস্থাপনাকে ‘কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন’ ঘোষণা করে, সে অনুযায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘ. নিয়মিত নজরদারি ও কঠোর শাস্তিবিধানের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। হঠাৎ কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি এসে যেন কোনো নাটক সৃষ্টি করতে না পারে।

ঙ. স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত মাসিক সভা করে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে তাঁরাও বকাবকি করার চেয়ে, বরং সমস্যা সমাধানের চাপে থাকবেন।

চ. অন্য সার্ভিসের মতোই একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তরে প্রত্যেকেরই দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে (পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন না করলেও)।

ছ. চিকিৎসকদের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখতে হবে। তাহলে এর দোহাই দিয়ে ফাঁকির সুযোগ কমে যাবে।

জ. কর্মস্থলে নিয়মিত উপস্থিতি, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় অবস্থানের জন্য বাড়িভাড়া না কেটে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

ঝ. কোনো যন্ত্রপাতি কেনার আগে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে।

ঞ. ধারণক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি বন্ধ করতে হবে, রোগীর যথাযথ চিকিৎসার স্বার্থেই।

ট. চিকিৎসকদের অধীনস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ঠ. কিছুদিন আগে এক হাসপাতালে পলস্তারা খসে গুরুতর আহত হন ডা. সুতপা রানী সাহা। এইসব বিপজ্জনক ভবন ও অবকাঠামোগুলো ভেঙে যথাযথভাবে নির্মাণ করতে হবে। এটাই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় মেগা প্রজেক্ট হওয়া উচিত।

সম্পাদক ও প্রকাশক : মঈনুদ্দিন কাজল
deshermatidaily@gmail.com
০১৬১৫১১২২৬৬, ০১৬৭৩৫৬২৭১৬

দেশের মাটি কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।