মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও জ্বালানি খাত নিয়ে পরিকল্পনা নেই বাজেটে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে কোনো পদক্ষেপ নেই। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত এবং জ্বালানি খাত নিয়েও কোনো পরিষ্কার পরিকল্পনার কথা নেই। বাজেটে ‘সুখী, ‘সমৃদ্ধ’, ‘উন্নত’—এসব শব্দ আছে। কিন্তু এসব করার জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত বাজেট–উত্তর আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাজেটে ‘সুখী, ‘সমৃদ্ধ’, ‘উন্নত’—এসব শব্দ আছে। কিন্তু গরিব মানুষের সুখী হওয়ার মতো কিছু নেই। বাজেট জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব করলেই সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাত নিয়ে বলতে বলতে হয়রান হয়ে গেছি। এই খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাত ঠিক না হলে বেশি দূর এগোনো যাবে না।’
সাবেক গভর্নর আরও বলেন, ‘বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ বৃদ্ধি ও জ্বালানি—এসব খাত নিয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি। বেসরকারি খাতের ঋণ কাদের কাছে যায়, তা আমরা জানি। এ জন্য ভবিষ্যতে গুলশান, বনানীর রেস্টুরেন্টে ভিড় আরও বাড়বে। একটি রুটি কিনলে আপনাকেও ১০ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। আবার “শাহ আলম’কেও ১০ টাকা ভ্যাট দিতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের পথের বাধা দূর করতে হবে। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যে পদে পদে বাধা আছে।
‘বাজেটে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে প্রবৃদ্ধির মোহ দেখা যায়’—এমন মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, পৌনে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বিনিয়োগ লাগবে। বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত জিডিপির তুলনায় ২৭ শতাংশ ধরা হয়েছে। কিন্তু ১০ বছর ধরে এই অনুপাত ২৩-২৪ শতাংশেই থমকে আছে। আবার বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমানো হয়েছে। তাহলে এত বিনিয়োগ আসবে কীভাবে—এই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সরকারি তরফে তেমন উদ্যোগ নেই। আবার ডলারের বাড়তি দামে আমদানি খরচ বেড়েছে। এমন অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা অসম্ভব। প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, ব্যাংক খাত ভঙ্গুর ও খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। এই খাত সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। এ ছাড়া কালোটাকা সাদা করার সুযোগকে সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অনৈতিক সুবিধা হিসেবে দেখেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, তিন মাস পরপর জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ের ফলে মানুষের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অস্থিরতাও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশা বাড়াচ্ছে। এই প্রত্যাশাজনিত মূল্যবৃদ্ধি কমানো না গেলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে প্রভাবশালীরা ব্যবসা করছেন না। এই টাকায় তাঁরা ব্যাংক কিনে ফেলছেন। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি দেশের ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কারণে শিল্প খাতে ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, এক ব্যাংকের ৬০ শতাংশ ঋণ গেল ৬ জনের কাছে। এমন ব্যাংকের এমডির মেয়াদ পাঁচবার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্র যদি লুণ্ঠনকারীদের পক্ষে কাজ করে, তাহলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ওপর কেন খেলাপি ঋণের দোষ চাপানো হয়? তাঁর মতে, বসুন্ধরায় জমি কিনলে ৪ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, আর অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি কিনলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হয়। এটা কি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ?
ইআরএফের ঢাকার পল্টনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফের নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম।