সবার অ্যাঞ্জেলিনা জোলি হবার প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন স্তন ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা “স্তন ক্যান্সার নিয়ে আতংক নয় ,চিকিৎসার চেয়ে জরুরি সচেতনতা !সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মূলত জিনঘটিত কারণে ৩৫–৪০ বছর বয়স পেরনো মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে !আলোচনাসভা, সচেতনতামূলক প্রচারের মধ্যে দিয়ে অক্টোবর মাসেই আমরা পালন করেছি ‘স্তন ক্যান্সার সচেতনতা’ মাস। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। তবুও অনেক ক্ষেত্রে আজও সচেতনতার অভাবে স্তন ক্যান্সারকে বশে আনা যাচ্ছে না। তবে সঠিক সময়ে এই রোগ ধরা পড়লে আধুনিক চিকিৎসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একে সম্পূর্ণ আয়ত্তের মধ্যে আনা সম্ভব।
স্তনের কিছু কোষ যখন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখনই স্তনে ক্যান্সার দেখা দেয়। মূলত মহিলাদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও পুরুষরাও এতে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে মহিলারা এ অসুখের ঝুঁকির মধ্যে যতটা রয়েছেন, পুরুষরা ততটা নন। স্তন ক্যান্সারের রোগীরা সাধারণত বুকে চাকা বা পিন্ডের মতো কিছু অনুভব করেন। তবে স্তনে চাকা বা মাংস পিন্ডের মতো কিছু মানেই ক্যান্সার, এমনটা নয়। অনেক ক্ষেত্রে স্তনবৃন্ত থেকে লালরঙের রস নিঃসরণ বা রক্তক্ষরণ, স্তনের ত্বকে অস্বাভাবিক কোনও পরিবর্তন, স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া ও সেখান থেকে চামড়া উঠতে থাকা ইত্যাদিকে এই রোগের লক্ষণ বলে ধরা হয়। যাঁরা এ ধরনের উপসর্গ উপেক্ষা করেন বা ভয়ে ও লজ্জায় চিকিৎসকের কাছে যান না, তাঁদের ক্ষেত্রে বগলের তলায় চাকা বা স্তনের ওপরের চামড়ায় কোঁচকানো ভাব বা ঘা নিয়ে উপস্থিত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বুঝে নিতে হবে যে, রোগটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তবে এই রোগে কখনই স্তনে ব্যথা অনুভূত হয় না। স্তন ক্যান্সার সাধারণভাবে ৩৫ বা ৪০–ঊর্ধ্ব মহিলাদের সমস্যা হলেও আমাদের দেশে ৩০–এর ঘরের মহিলারাও এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। নিঃসন্তান মহিলা বা যাঁরা কোনও কারণে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেননি তাঁদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া স্তন ক্যান্সারের বংশগত বা জেনেটিক দিকও আছে। পরিবারের কোনও মহিলা এই রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর মা বা বোন অথবা মেয়ের (ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ) ক্ষেত্রে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি ২২%–৩৩% বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত ৮টি স্তন ক্যান্সারের জিন আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে বিআরসিএ ১ এবং বিআরসিএ ২ উল্লেখযোগ্য। লক্ষণ দেখা দিলে ডায়াগনসিসের জন্য সবচেয়ে ভাল ট্রিপল অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি। যেখানে প্রথমে একজন স্তন ক্যান্সার সার্জেন রোগীর পরীক্ষা করবেন ও তাঁর পরিবারিক ইতিহাস জানবেন। এরপর রোগীর ম্যামোগ্রাম বা স্তনের আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান করা হবে এবং সার্জেন রোগীর লাম্প বা স্তনের ডেলা থেকে এফএনএসি বা কোর বায়োপ্সি করবেন। এখন এফএনএসি–র বদলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোর বায়োপ্সি করা হয়। কারণ এফএনএসি–র চেয়ে কোর বায়োপ্সি অনেকটাই উন্নত পদ্ধতি। অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে সাধারণত আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান করা হয়। ৩৫ বছর বয়সের বেশি মহিলাদের ক্ষেত্রে রোগ শনাক্তকরণের জন্য ম্যামোগ্রাম করা হয়। স্তন ক্যান্সার ধরা পড়লে প্রথমে কিছু রক্ত পরীক্ষা ছাড়া বুকের এক্স–রে, বোন স্ক্যান এবং লিভারের আলট্রাসোনোগ্রাফি করা উচিত। যদি দেখা যায়, ক্যান্সার এই সমস্ত অঙ্গে ছড়ায়নি তবেই একমাত্র কিউরেটিভ সার্জারি এবং কেমোথেরাপি করে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব। বর্তমানে সম্পূর্ণ স্তন বাদ না দিয়েও স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্ভব। এক্ষেত্রে অপারেশনের পরে রোগীকে রেডিওথেরাপি নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে শুধুমাত্র টিউমারটি বাদ দিয়ে স্তনের বাকি অংশে রেডিওথেরাপি বা রে দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এই সার্জারির সময় বগলের নীচের অংশের গ্ল্যান্ডগুলো সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয় এবং বায়োপ্সির রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে রোগীর কেমোথেরাপির প্রয়োজন আছে কিনা। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা না পড়ে অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পর ধরা পড়ে, তখন নিও–অ্যাডজুভ্যান্ট কেমোথেরাপি দিয়ে সার্জারি করাটাই ভাল। বয়স যেমনই হোক প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার নির্ণয় করতে পারলে প্রায় সমস্ত রোগীকেই সারিয়ে তোলা সম্ভব। অপারেশন, কেমোথেরাপি ছাড়াও রয়েছে হরমোন থেরাপি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার হরমোন রিসেপ্টর সেন্সেটিভ হয়। এক্ষেত্রে রোগীদের অ্যান্টি–ইস্ট্রোজেন হরমোন জাতীয় কোনও ওষুধ দিলে, তা খুবই কার্যকরী ভূমিকা নেয়। হরমোন ছাড়াও ‘হার টু নিউ’ নামে এক ধরনের রিসেপ্টর রয়েছে। এক্ষেত্রে হারসেপটিন নামে একটি ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধটি ব্যয়বহুল হলেও, স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় যার সাফল্য খুবই আশানুরূপ। যাঁদের বয়স খুব বেশি সে সব রোগীর সার্জারি বা কেমোথেরাপি না করে, হরমোন থেরাপির মাধ্যমে বেশ কিছুটা সময় রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আর আছে ইমিউনোথেরাপি। তবে এই ধরনের চিকিৎসা একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্রেস্ট সার্জেনের তত্ত্বাবধানেই করা উচিত। এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে ৮০–৮৫ শতাংশ মহিলাকে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার ধরতে প্রত্যেক মহিলাকেই নিজের শরীর নিজেকেই নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এ ছাড়া যাঁরা ৪০–ঊর্ধ্ব মহিলা, বিশেষ করে যাঁদের পরিবারে ব্রেস্ট ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী আছেন, তাঁদের উচিত নিয়মিত ম্যামোগ্রাম করানো। এই পরীক্ষায় এক বিশেষ ধরনের এক্স–রে–র সাহায্যে স্তনে চাকা অনুভব করার অনেক আগেই ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ক্যান্সারের জীবাণু আপনার শরীরে বাসা বাঁধছে কিনা সেটা আগে থেকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়াটাই ভাল। মাসে একবার নিজেই নিজের পরীক্ষা করুন। অর্থাৎ সেলফ অ্যাসেসমেন্ট। পিরিয়ডের এক সপ্তাহ পরে, সাধারণভাবে স্নান করার সময় বা জামাকাপড় পরার সময়ে এই পরীক্ষা করতেই পারেন। আয়নার দু’পাশে হাত রেখে দাঁড়ান। দু’দিকের স্তনের মধ্যে কোনও অসামঞ্জস্য আছে কিনা লক্ষ করুন। এবার মাথার ওপর দু’হাত তুলুন। মাথার পাশে রাখুন। দেখুন দু’দিকে কোনও অসামঞ্জস্য নজরে পড়ে কিনা। হাতের চেটো দিয়ে প্রথমে একদিকের ও পরে অন্যদিকের স্তন পরীক্ষা করুন। কোনওরকম চাকা বা ফোলা ভাব আছে কিনা ভাল করে লক্ষ করুন। এবারে দেখুন নিপ্ল বা স্তনবৃন্তে কোনও পরিবর্তন হয়েছে কিনা। পরিবর্তন বলতে একদিকের নিপ্ল ভেতর দিকে ঢুকে গিয়েছে কিনা বা নিপ্লের পাশে কোনও ঘা আছে কিনা। যদি ঘা–এর সন্ধান পান তাহলে অবিলম্বে ব্রেস্ট ক্যান্সার সার্জেনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে সুস্থ জীবনে ফেরাটা কঠিন নয়। এই অসুখের চিকিৎসায় সবচেয়ে ভাল মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম। এই টিমের তত্ত্বাবধানে স্তন ক্যান্সার ও এই সংক্রান্ত সবরকম সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। অসুখ–বিসুখ নিয়ে কোনওরকম লজ্জা বা তা চেপে না রাখাই ভাল। এতে রোগের বাড়বাড়ন্তটা অনেকটাই বেড়ে যায় এবং তখন তাকে নিয়ন্ত্রণে আনাটা অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। স্তন ক্যান্সারের মতো অসুখ নিয়ে অযথা ভয় না পেয়ে, উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করুন। স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতিতে গত দশ বছরে আমূল পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিম দুনিয়ায় ব্রেস্ট সার্জারি আলাদা বিষয় বা স্পেশ্যালিটি বলে গণ্য করা হচ্ছে। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক অথবা নার্সরা শুধুমাত্র ব্রেস্ট সংক্রান্ত সমস্ত চিকিৎসা করা হয় ! আমাদের দেশে এর অত্যাধুনিক চিকিৎসা শুরু হয়েছে সফলভাবে !একমাত্র স্বাস্থ্যসচেতনতার মাধ্যমেই উন্নততর দেশগুলো স্তন ক্যান্সারের মোকাবিলা করতে পেরেছে। সবাইকে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি হতে বলছি না যিনি তাঁর দেহে বিআরসিএ ১ জিনের উপস্থিতি জানতে পেরে (স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা ছিল ৮৭%) সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকারের উপায় হিসেবে দুটি স্তনই বাদ দিয়ে দেন। তবে দ্রুত চিকিৎসা করিয়ে ভারতীয় নায়িকা মুমতাজ কিংবা জেন ফন্ডার মতো অসংখ্য সেলিব্রিটি দিব্যি বেঁচে আছেন বিশ্বজুড়ে।নিকাশ কালো রাতের পর ভোরের আলো আসবেই !
ডাঃ কৃষ্ণারুপা মজুমদার
সহযোগী অধ্যাপক
জেনারেল এবং ক্যান্সার সার্জারি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
চেম্বার ঃ আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতাল
ধানমন্ডি , ০১৭৭৭১৩১৩৯১