আইএমএফ আর্থিক খাতে সংস্কার চায়
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার ও সুশাসন নিশ্চিতে সংস্কার কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের আর্থিক খাতের ঋণ প্রতিবেদন প্রণয়নে স্বচ্ছতা আরও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে সংস্থাটি অতিমূল্যায়িত বা টাকার মান বেশি বলে মনে করে। এ কারণে টাকার মান বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে ডলারের দাম আরও বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।
এদিকে দুর্নীতি কমাতে প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের তালিকা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে তাদের দেওয়া সম্পদের তালিকা প্রতিবছর হালনাগাদ করতেও বলেছে। সংস্থাটি মনে করে, এতে সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে দুর্নীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে।
গত সোমবার রাতে প্রকাশিত আইএমএফের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ডিসেম্বরের মধ্যে আর্থিক খাতের বেশ কিছু শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার ও সুদের হারে যে সংস্কারমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে আইএমএফ সাহসী পদক্ষেপ বলে মনে করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে সব খাতে নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন ব্যবস্থা। এজন্য দ্রুত চলমান সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে আর্থিক খাতে ঋণসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো তৈরি করতে হবে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের করতে হবে। ঋণবিষয়ক যেসব প্রতিবেদন ব্যাংকগুলো তৈরি করে সেগুলোতেও সংস্কার আনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারভিশন ব্যবস্থাও আধুনিকমানের করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে জোর দিয়েছে আইএমএফ।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলেছে, আইএমএফ ঝুঁকিভিত্তিক যেসব কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা বলেছে, সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে থেকেই করছে। ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এখন একে আরও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের নয়। এখানে অনেক ছাড় দিয়ে সংজ্ঞা করা হয়েছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য হলেও তার কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ মাস পর বাংলাদেশে খেলাপি হচ্ছে। এছাড়া ঋণ বিতরণের পর যেসব প্রতিবেদন করা হয় সেগুলোতে যথেষ্ট ফাঁকফোকর রয়েছে। প্রতিবেদন দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ঋণটি কি আদৌ ভালো অবস্থায় আছে নাকি খেলাপির দিকে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান এখনও অতিমূল্যায়িত। অর্থাৎ বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে এর দাম নির্ধারিত হচ্ছে না। এ কারণে তারা ডলারের দাম আরও বাড়ানো ও টাকার মান কমানোর সুপারিশ করেছে। এ লক্ষ্যে বাজারের মৌলিক উপাদানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করতে হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, তারা ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে কাজ করছে। এর অংশ হিসাবেই ক্রলিং পেগ (একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে ওঠানামার সুযোগ দেওয়া) চালু করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো অভ্যস্ত হলেই বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের দিকে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশীয় ব্যাকিং ব্যবস্থার শাসন কাঠামো, স্বচ্ছতা এবং আর্থিক সুস্থতা উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় খেলাপি ঋণ কমানোর রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকে এমডি, পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধিবিধান জারি করেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের শুরু থেকে উচ্চ এবং অস্থির খাদ্যমূল্য, জ্বালানি ও সারের দাম ঊর্ধ্বমুখী এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্র হয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাষ্টিক অর্থনীতিতে বড় চাপের সৃষ্টি হয়েছে। আইএমএফের ঋণ এই চাপকে মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগোতে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। সংস্থাটির ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে যেসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান তার আলোকে অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা করার সুপারিশ করবে আইএমএফ।