বরিশাল এলজিইডির অপকর্মের হোতা মিরাজুল
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে সরকারী উন্নয়নমূলক কাজের বিভিন্ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করতো মিরাজুলের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার মধ্যে পিরোজপুরের উন্নয়ন কাজের মান সবদিক দিয়ে খারাপ জেলা। এই জেলার কাজের মান খারাপ হওয়ার জন্য মিরাজুল ইসলাম দায়ী, এমনটাই মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মিরাজুল পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান।
তিনি ভান্ডারিয়রা-কাউখালী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য মহারাজ এর ছোটো ভাই। সাবেক সাংসদ মহারাজ একসময় জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কথিত আছে এই নির্বাচনে জেতার জন্য তার ভাই ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেন।
পিরোজপুর জেলায় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর পোষ্টিং হতো এই দুই ভাইয়ের ইচ্ছানুযায়ী। প্রথমদিকে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়ে আসেন আব্দুল হাইকে। তার সাথে মতবিরোধ হলে নিয়ে আসেন নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল হাসানকে। তিনি সেখানে প্রায় চার বছর ছিলেন; তার সময়ের এলজিইডি পিরোজপুরের কাজের মান খুব খারাপ হলে তাকে প্রধান প্রকৌশলী তুলে নিয়ে আসেন।
এরপর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে নিয়ে আসা হয় এলজিইডির সবচেয়ে সমালোচিত প্রকৌশলী জনাব সুশান্ত রঞ্জন রায়কে। তিনি এমন কোনো অপরাধ নাই যা এদের পক্ষে করেন নাই; টেন্ডারবাজি, অপ্রয়োজনীয় রিভাইস, ওভারপেমেন্ট, ডুপ্লিকেশন (একই স্কীম একের অধিক প্রকল্প থেকে টেন্ডারকরণ) ইত্যাদি অনেক ভয়ানক অপরাধ।
সুশান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ভারী হলে কর্তৃপক্ষ তাকে সরানোর উদ্যোগ নেয়, আরেক দুর্নীতিপরায়ন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদারকে নিয়ে আসা হয়। তিনি গত জুন মাসে অবসরে গিয়েছেন। এরপর নিয়ে আসা হয় অনৈতিক কাজের মাস্টারমাইন্ড বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী রনজিত দেকে।
পরবর্তীতে মিরাজুল ইসলাম তৎকালীন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী রশীদের সহযোগীতায় (কোটি টাকার বিনিময়ে) সুশান্ত রঞ্জন রায়কে ‘বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরোজপুর’ (ইঔচ) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পাওয়িয়ে দেন।
এই প্রকল্পের আওতায় পিরোজপুর জেলায় ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড কাজ পায়। যাহার প্রোপ্রাইটর মিরাজুল ইসলাম। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য (ওইজচ) নামে একটি প্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন আহমদ আলী। তাকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সুশান্ত রঞ্জন রায়কে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ আহমেদ আলী জানতে পারেন তার প্রকল্পের প্রায় ১৫/২০টি ব্রীজের কাজ শুরুই হয়নি। অথচ ৮৫% পেমেন্টের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এই কাজগুলো করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। কাজগুলোর ওভারপেমেন্ট, ডুপ্লিকেশন, টেন্ডারিং ইত্যাদি ঘাপলাসহ আহমেদ আণলীর বিষয়টি পুণঃতদন্ত করে দেখা উচিত বলে সংশিষ্টরা জানান।
ইউওজডঝচ প্রকল্প এর কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। শুরুতেই এই প্রকল্প থেকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার স্কীম বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বানের নিমিত্তে অনুমোদন দেয়া হয়। ঐ অর্থ-বছরেই পিরোজপুর জেলায় প্রকল্প পরিচালক ১১০ কোটি টাকা ছাড় করেন। কাজগুলোর বেশিরভাগই নামে-বেনামে বাস্তবায়ন করছে ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। তাদেরকে বরাদ্দকৃত টাকার প্রায় পুরোটাই দিয়ে দেওয়া হয়। অথচ তখন পর্যন্ত মাঠে ৫% কাজও বাস্তবায়িত হয়নি। তাকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করার জন্য মিরাজ কোটি টাকার বেশি মন্ত্রীকে প্রদান করেন।
টঐইচ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন মোঃ সেলিম মিয়া। এ প্রকল্পের অধীনে পিরোজপুর জেলায় ১৮টি ব্রীজ নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। প্রায় সবগুলোর কাজ করার দায়িত্ব পায় ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। এসব স্কীমের ১৪টি তারা নিজে করছে। এই ১৪টি কাজের কোনো কাজই শুরু হয়নি, অথচ পরিশোধ করা হয় চুক্তিমূল্যের প্রায় ৮৫% টাকা ।
ঈঅঋউজওজচ প্রকল্প এর মাধ্যমে পিরোজপুর জেলায় ৭০ এর অধিক স্কীম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ রফিকুল হাসান। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এর মধ্যে প্রায় ৬৫টি স্কীম ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড পেয়েছে। এ প্রকল্পের কাজগুলোর টেন্ডারিং প্রক্রিয়াসহ গুণগতমান নীরিক্ষার জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে পরিদর্শন করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। পিরোজপুর জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ ইব্রাহীম। মিরাজের ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
মিরাজের সাথে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও ভান্ডারিয়া নিবাসী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব তোফাজ্জেল হোসেনের দহরম-মহরম সম্পর্ক। মূলত এদেরকে ব্যবহার করে বরিশাল বিভাগের সমস্ত প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
এলজিইডি সূত্র জানায়, দেশের পরিবর্তীত সর্বত্র সংস্কার হলেও এখানকার বিতর্কিত কর্মকর্তারা এলজিইডি মন্ত্রণালয়সহ সর্বত্র দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের এই দৌরাত্বের সীমা শুরু বরিশাল বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এলজিইডির আওতাধীন বাংলাদেশের সমস্ত প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগে মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করেছেন। অনতিবিলম্বে বরিশাল বিভাগের সমস্ত প্রকল্প পরিচালদেরকে দায়িত্ব থেকে অপসারন করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিয়োগদানের পরামর্শ সংশিষ্টদের।
এ ব্যাপারে মিরাজুল ইসলামের বক্তব্য জানতে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে বর্তমান ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে তিনি আত্মগোপনে থাকায় তার মতামত জানা সম্ভব হয়নি।