মোদীর নতুন সরকারের ২৮ মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা
টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতে সরকার গঠন করেছে হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। দলটির নেতা নরেন্দ্র মোদীও টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। গত ৯ জুন, রবিবার প্রধানমন্ত্রী মোদীসহ তার নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নিয়েছেন।
মোদীর নতুন সরকারে মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আরও ৭১ জন মন্ত্রী জায়গা পেয়েছেন। ওই ৭১ জনের মধ্যে ৩০ জন কেবিনেট মন্ত্রী, সুনির্দিষ্ট দপ্তর ছাড়া মন্ত্রী পাঁচজন এবং ৩৬ জন প্রতিমন্ত্রী।
এর মধ্যে মাত্র ১১ জন বিজেপির বাইরে থেকে তথা বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোটের বিভিন্ন শরিকদল থেকে এসেছেন। তার মানে আগের দুই মেয়াদের চেয়ে খুব বেশি বিজেপিহীন মন্ত্রিসভা হয়নি এবারও।
যদিও এবারের নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছিল, মোদীকে হয়ত এবার তার মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদ ছেড়ে দিতে হবে শরিকদের জন্য।
কিন্তু মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণার পর দেখা গেল, বিজেপি সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজের হাতেই রেখেছে।
তবে মোদীর তৃতীয় মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের পর জানা গেল, নরেন্দ্র মোদী নতুন সরকারের ৭২ জন মন্ত্রীর মধ্যে ২৮ জনের বিরুদ্ধেই রয়েছে ফৌজদারি অপরাধের মামলা, যা শতাংশের বিচারে ৩৯ শতাংশ।
এদের মধ্যে আবার ১৯ জনের (মন্ত্রিসভার ২৭ শতাংশ সদস্য) বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, অপহরণ, নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
ভোটাধিকার সংক্রান্ত সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস’ (এডিআর) এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
এডিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এই দুজন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ ধারার অধীনে হত্যাচেষ্টা সম্পর্কিত মামলার সম্মুখীন। এরা উভয়ই আবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত।
প্রথমজন হলেন- জাহাজ প্রতিমন্ত্রী তথা বনগাঁর বিজেপি এমপি শান্তনু ঠাকুর। দ্বিতীয়জন, শিক্ষা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তথা বালুরঘাটের এমপি সুকান্ত মজুমদার।
এডিআরের প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, মোদীর তৃতীয় মন্ত্রিসভার পাঁচজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। এই পাঁচজন হলেন- তিন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বন্দি সঞ্জয় কুমার, ঠাকুর, মজুমদার; পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস এবং পর্যটন মন্ত্রী সুরেশ গোপী এবং আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী জুয়াল ওরাম। সুরেশ গোপী কেরালা থেকে বিজেপির একমাত্র প্রতিনিধি।
এছাড়াও এডিআরের প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আট মন্ত্রীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বস্ত্রমন্ত্রী গিরিরাজ সিংও রয়েছেন।
মোদীর এবারের মন্ত্রিসভায় নেই মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট থেকে কোনও মুসলমান এমপি হননি। এটা মন্ত্রিসভায় কোনও মুসলমান না থাকার কারণ হতে পারে।
এমনকি ৫৪৫ আসনের লোকসভায় এবার মাত্র ২৪ জন মুসলমান নির্বাচিত হয়েছেন, যা ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে সর্বনিম্ন। এদের ২১ জনই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থী।
মোদীর এবারের মন্ত্রিসভায় নারী প্রতিনিধিও কম, এমন অভিযোগও উঠেছে।
এমন পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় মন্ত্রিসভা নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করল অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস বা এডিআর।
এছাড়া এডিআরের প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, মোদীর এবারের মন্ত্রিসভার ৯৯ শতাংশ সদস্য কোটিপতি। প্রতিজন মন্ত্রী গড়ে ১০৭.৯৪ কোটি রুপির মালিক। ৬ জন মন্ত্রীর প্রত্যেকের সম্পদ ১০০ কোটি রুপির বেশি।
এবারের বিজেপি সরকারের সবচেয়ে ধনী মন্ত্রী হলেন ডা. চন্দ্র শেখর পেমমাসানি। তিনি বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের শরিকদল তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে পল্লী উন্নয়ন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।
ড. চন্দ্র শেখর পেমমাসানির মোট সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার ৭০৫ দশমিক ৪৭ কোটি রুপি। এর মধ্যে অস্থাবর সম্পদ ৫ হাজার ৫৯৮ দশমিক ৬৫ কোপি রুপির, আর স্থাবর সম্পদ ১০৬ দশমিক ৮২ কোটি রুপির। তিনি সম্ভবত ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী মন্ত্রী।
৪৮ বছর বয়সী চন্দ্র শেখর পেমমাসানি পেশায় একজন ডাক্তার। ২০২৪ সালেই তিনি প্রথম নির্বাচন করে এমপি ও মন্ত্রীও হয়েছেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য পেমমাসানিকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
তিনি ইউওয়ার্ল্ড ডটকম (uworld.com) নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা, যেটি কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠের উপকরণ এবং টেস্ট সিরিজ সরবরাহ করে।
২০২০ সালে একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে পেমমাসানি যুক্তরাষ্ট্রের আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত হন।
পেমমাসানি নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা শিবিরের আয়োজন করে এবং গ্রামের মানুষদের খাবার পানি সরবরাহ করে।
বিরোধী জোটের ৭ এমপির বিরুদ্ধেও ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্সের (ইন্ডিয়া) সাত এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
তাদের সবাই উত্তর প্রদেশ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এই এমপিদের মধ্যে পাঁচজন সমাজবাদী পার্টির (এসপি), একজন কংগ্রেসের, আর একজন আজাদ সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর আজাদ, যিনি নাগিনা আসনে জয়ী হয়েছেন।
এই এমপিরা ফৌজদারি অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে নিজেদের এমপি পদ হারানোর ঝুঁকিতেও রয়েছেন। এদের মধ্যে উত্তর প্রদেশের আলোচিত গ্যাংস্টার পরিবারের সদস্য আফজাল আনসারিও রয়েছেন।
ভারতের ইতিহাসে এর আগে একাধিক এমপি ফৌজদারি অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাদের সংসদ সদস্যপদ হারিয়েছেন। এই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের চলমান আইনি চ্যালেঞ্জও একইভাবে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিণতি ঘটাতে পারে।