‘আমরা চাইলে খুব সহজেই লেবাননকে অন্ধকারে ফেলে রাতারাতি হিজবুল্লাহর সব শক্তি মূলোৎপাটন করতে পারি।’ সম্প্রতি ইসরাইলের রাইখম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কনফারেন্সে এমন মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে মন্ত্রী পর্যায়ের কোনো নেতার এটিই সবচেয়ে বড় হুমকি। এর আগে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে এমন স্পষ্ট হুমকি কেউ দেননি।
অবশ্য লেবাননকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করা ইসরাইলের জন্য কঠিন কিছু নয়। কয়েক দশকের অব্যবস্থাপনা আর অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে ইতোমধ্যে পঙ্গু দেশটির পাওয়ার গ্রিড খুব কমই কাজ করছে। কয়েকটি বিমান হামলা চালালেই বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়বে পুরো দেশ। তবে হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি কেড়ে নেওয়া মুখের কথা নয়, লম্বা কাজ।
২০০৬ সালে লেবাননের সঙ্গে অসমাপ্ত যুদ্ধের পর থেকেই পুনরায় ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা করে আসছে ইসরাইল। থেমে নেই হিজবুল্লাহও, দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগঠনটি।
বিশাল অস্ত্রাগার
ইসরাইলের হিসাব বলছে, হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারে অন্তত দেড় লাখ ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার ক্ষেপনাস্ত্র খরচ করে ফেলেছে তারা। তবে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ বলছেন ভিন্ন কথা। গত সপ্তাহে এক ভাষণে তিনি জানান, তাদের বেশিরভাগ অস্ত্রাগার এখনো অক্ষত।
সম্প্রতি ইসরাইলের সামরিক স্থাপনায় হামলার দাবি করেছে হিজবুল্লাহ। গোষ্ঠীটির সাম্প্রতিক হামলায় অবাকও হয়েছেন ইসরাইলি কর্মকর্তারা। এর মধ্যে রয়েছে- সীমান্তে ইসরাইলের নজরদারি ফাঁড়িতে হামলা, ইসরাইলি ড্রোনে গুলি করে ভূপাতিত করা এবং ইসরাইলের ড্রোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানা। তবে ইসরাইলের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল- হিজবুল্লাহ উত্তরাঞ্চলীয় শহর হাইফা ও এর আশেপাশের অত্যন্ত সংবেদনশীল বেসামরিক ও সামরিক অবকাঠামোর নয় মিনিটের ড্রোন ফুটেজ অনলাইনে প্রকাশ।
বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ছাড়াও হিজবুল্লাহর রয়েছে একদল প্রশিক্ষিত সেনাদল। ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার যোদ্ধা মোতায়েনের সক্ষমতা রয়েছে হিজবুল্লাহর। তবে হাসান নাসরুল্লাহ সম্প্রতি জানিয়েছেন, এ সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। এদের অনেকেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সরকারি বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এছাড়াও হিজবুল্লাহ অন্যান্য অনেক গেরিলা গ্রুপের চেয়ে প্রশিক্ষিত এবং অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ।
সক্ষমতা বেড়েছে বহুগুণ
রাইখম্যান বিশ্ববিদ্যালয় হিজবুল্লাহর গোলাবারুদের মজুদ আর রকেট নিয়ে অবাক করার মতো এক তথ্য দিয়েছে। এক প্রতিবেদনে তারা জানায়, যুদ্ধ বাধলে এবার একদিনে প্রায় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার রকেট হামলা করতে পারে ইরানের এ মিত্র গোষ্ঠী। অথচ ২০০৬ সালে পুরো ৩৪ দিনের যুদ্ধে হিজবুল্লাহ মাত্র চার হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছিল বলে অনুমান করা হয়, যা দৈনিক গড়ে ছিল মাত্র ১১৭টি।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে ১৩ জুলাই যুদ্ধ শুরুর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো বোমা হামলায় বৈরুতের রফিক হারিরি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। তবে এবার ইসরাইল ওই বিমানবন্দরটিতে হামলা চালাতে পারলেও আগেরবারের মতো এতো তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারবে না। অন্যদিকে হিজবুল্লাহও তেল আবিবের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আঘাত হানতে সক্ষম হতে পারে এবার।
মধ্যপ্রাচ্যে বেড়েছে ইসরাইলের শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের শত্রু-মিত্রের অবস্থা আগের মতো নেই। রাষ্ট্র ছাড়াও অরাষ্ট্রীয় শত্রু র সংখ্যা বেড়েছে। অনেক শক্তিও অর্জন করেছে সংগঠনগুলো। ইসরাইলের শত্রুরা এখন আর দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য আরব শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং হিজবুল্লাহ থেকে শুরু করে হামাস, ইসলামিক জিহাদ, হুথি থেকে ইরাক ও সিরিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী ছাড়াও অ-রাষ্ট্রীয় অনেক শত্রুর জন্ম হয়েছে।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও এখন ইরানের সহায়তায় ইসরাইলের দিকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার সাহস পায়। হুতিরাও লোহিত সাগরে ইসরাইলের জাহাজে হামলা করে।
সম্প্রতি ইরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনী আসাইব আহল আল-হকের নেতা কায়েস আল-খাজালি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি লেবাননে ইসরাইলি হামলা সমর্থন করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের জানা উচিত এ অঞ্চলে বিশেষ করে ইরাকে সে তার সব স্বার্থ ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
ইরানের আচরণিক পরিবর্তন
গত কয়েক বছরে ইরানের চরিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ঐতিহ্যগতভাবে তেহরান অন্যদেরকে লড়াই করার জন্য উসকে দিয়ে নেপথ্যে থাকে। তবে গত এপ্রিলে দেশটি বিপরীত আচরণ করেছে। সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক দপ্তরে ইসরাইলের হামলার কঠিন প্রতিশোধ নিয়েছে। ইসরাইলের দিকে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালিয়েছে তেহরান।
যদি ইরানের প্রধান আঞ্চলিক মিত্র ও দেশটির ‘মুকুট রত্ন’ হিজবুল্লাহকে ইসরাইল আক্রমণ করে তবে ইরান এর বিপরীতে মারাত্মকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
ইরান তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ইচ্ছেমতো গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে পারে। সেইসঙ্গে পারস্য উপসাগরে প্রবেশের প্রবেশদ্বার হরমুজ প্রণালী নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। বড় ধরনের সংঘাত দেখা দিলে ইরান এই প্রণালী বন্ধ করে দেবে বলে দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকাশচুম্বী করে তুলবে।
গত অক্টোবর থেকে লেবানন-ইসরাইল সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েই চলছে। তবে গত কয়েক সপ্তাহে এ উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে এবং যুদ্ধের সম্ভাবনাও আকাশচুম্বি বলে মনে হচ্ছে। জার্মানি, সুইডেন, কুয়েত, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের অবিলম্বে লেবানন ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যদি কখনো আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়, সেই মুহূর্ত এখনই।