করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর সাড়ে ৭ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। না দেখা এক নতুন ঘাতকের কাছে বিশ্বের কয়েক লাখ মানুষ হেরে গেছেন। সাড়ে ৭ লাখের পর-ই মৃত্যুর সারি থেমে গেছে বা থেমে যাবে-এমন কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে রাজি নয়।
শুধু তাই নয়, মৃত্যুর এই সংখ্যা ভ্যাকসিন আবিস্কারের আগ পর্যন্ত কত লাখে গিয়ে পৌছাবে তারও কোনো কিনারা করতে পারছে না, পৃথিবীর তাবৎ প্রযুক্তির ধারক-বাহকরাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ ব্রিফিংয়ের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, এই ঘাতক নির্মুলের ভ্যাকসিন সহসাই মিলছে না। ফলে করোনাভাইরাস সামনে আরো ভয়াবহ পরিণতি এনে দিতে পারে।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম চীনের উহান প্রদেশে এ ভাইরাসটি চিহিৃত হয়। এরপর দেশে দেশে ছড়িয়ে ধীরে ধীরে পৃথিবীর মানুষের জীবনচিত্র নির্মমভাবেই বদলাতে শুরু করে। একদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অন্যদেশ। গত ১০ এপ্রিল বিশ্বে মৃতের তালিকায় ১ লাখ মানুষের নাম উঠেছিল। এর ঠিক ১৫ দিনের মাথায় ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে ২ লাখ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা জানায় যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা মিটার। ঘড়ির কাটার তালে মৃত্যু বেড়েছে। হাহাকার থামেনি কোনো এক দিন বা গভীর রাতের মুহুর্তেও। চূড়ান্ত পরিণতি মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশী সময় ৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ১০ টায় সেই হাহাকার পার হলো ৭ লাখের ঘর।
করোনা মিটার বলছে, মৃত এই ৭ লাখের মধ্যে শুধু প্রায় একলাখ ৭০ হাজার-ই বিশ্বের প্রবল প্রযুক্তি ও পরাশক্তির দাবিদার আমেরিকার মানুষ। আর সব মিলিয়ে সারা বিশ্বে এ মুহুর্তে এ ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ১১ লাখের বেশি। আক্রান্তের সবশেষ হিসেবে বিশ্বে শীর্ষ ৩ দেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে প্রতিবেশী ভারতের নাম, যেখানে মৃত্যুর তালিকার নাম উঠেছে ৪৮ হাজার মানুষের।করোনা মিটারের এ তালিকায় ২০টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশও। গত ১৪ আগষ্ট বাংলাদেশে করোনা পজেটিভিটির হার ছিল ২১ দশমিক ৫২ ভাগ। তবে মৃত্যুর নিম্ম হার এ জনপদে এখনো স্বত্বির কারণ হয়ে আছে। অবশ্য এ ঘাতক বাংলাদেশেও কেড়ে নিয়েছে ৩ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ।
তবে হঠাৎ করেই সব ছাপিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ব্রাজিল এখন আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। আক্রান্তের তালিকায় এখন তা ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের নিচে ৩২ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যুর তালিকায়ও ১ লাখ ৫ হাজার মানুষের প্রাণহানির বিনিময়ে ব্রাজিল এখন ২য় স্থানে। পিছু নিয়েছে মেক্সিকোও, যে দেশে মারা গেছেন এখন পর্যন্ত ৫৫ হাজার মানুষ।
অপরিচিত ও নতুন এ ঘাতকের কাছে মাত্র ৬ মাসেই বিপুল সংখ্যক মানুষের এ পরাজয় ঘটেছে এক অদৃশ্য লড়াইয়ে। কোনো একটি বিশেষ দেশের মানুষ নন, পৃথিবীর ২১০ দেশ ও অঞ্চলে বিদ্যা-বুদ্ধি-প্রযুক্তির সবার উপরে থাকা দেশগুলোই মৃতের এ তালিকায়, সবার উপরে থেকেই নিজেদের নামগুলো ভাগ করে নিয়েছে। এবং পৃথিবীর আর কোনো প্রাণী নয়, এই ঘাতকের মুল আঘাত এসেছে শুধু মানুষের উপর-ই।
নি:শেষ হবার এ তালিকায় আলোড়ন তোলা ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন দেশ ইতালিতে মারা গেছেন ৩৫ হাজার মানুষ।ব্রিটেনে ৪৬ হাজার ও রাশিয়ায় ১৪ হাজার মানুষ মারা গেছেন। তারপর স্পেন ২৮ হাজার ও ফ্রান্স ৩০ হাজার ২৯৪ জন। পিছিয়ে থাকেনি বেলজিয়াম, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডের মতো সর্বাধুনিক উন্নত দেশগুলো। ইরানে ১৭ হাজার ৬১৭ জন মারা গেছেন।
নানারকম প্রচেষ্টায় পৃথিবীর দেশগুলো একে অপরের থেকে, দেশে দেশে মানুষ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও বিশ্বে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যায় তার গতি কমায়নি। এখনো ২৪ ঘন্টায় আক্রান্ত হয় বিশ্বের লাখ মানুষ, এখনো ২৪ ঘন্টায় কোনো দেশে মারা পড়ছে হাজারের বেশি মানুষ। আবার আক্রান্ত বিপুল মানুষের অনেকের অবস্থা ভালো, সুস্থ হয়ে চলেছেন বাড়ির পথে।
ব্রাজিলের গভীর বনাঞ্চল আমাজনের আদিবাসী তরুন থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, প্রিন্স চার্লসও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন। আতঙ্কে শরীরের বিশেষ নমুনা পরীক্ষা করতে বাধ্য হন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও।
করোনাভাইরাসে প্রথমে চীনে, তারপর হংকং, ফিলিপাইন্স ও জাপানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ইউরোপে প্রথম ব্যক্তি মারা যান গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর প্রথমে সময় নিয়ে পরে তীব্র আঘাতে তা কুপোকাত করে আধুনিক ইউরোপকেই।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা মিটারে একটু তাকিয়ে থাকলেই আক্রান্ত ২শ ১৩ টি দেশ ও অঞ্চলের কোনো না কোনো জায়গা থেকে এসে সংখ্যা আবার বাড়িয়ে তুলছে।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর কাটা অনবরত ঘুরছেই। অবশ্য করোনা মিটার বলছে, এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ কোটি ৩৯ লাখের বেশি।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম শনাক্তের পর ১৮ মার্চ এ ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। তারপর এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ঠ মানুষ ও বড় ব্যবসায়ি। সবশেষ হিসেবে করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে ২শ ১৫ জনের বেশিসহ সারাবিশ্বে প্রায় ৫ শতাধিক বাংলাদেশী মারা গেছেন।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব দেশের সরকারকে তার জনগনকে মাস্ক পড়তে উৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছে। তবে জুনের শুরুতে সংস্থাটির পরিচালক ট্রেড্রোস ঘেব্রেয়েসাস এও বলেছেন, শুধু মাস্ক কোভিড-১৯ থেকে কাউকে সুরক্ষিত করবে না।