অর্থ - বানিজ্য

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ বাবদ ১১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার বৃহস্পতিবার রাতে ছাড় করা হয়েছে। ওই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে যোগ হয়েছে। ফলে নিট রিজার্ভ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬২ কোটি ডলার।

আইএমএফের ঋণের কিস্তির অর্থ পাওয়ায় দীর্ঘ সময় পর নিট রিজার্ভ আবার ২ হাজার কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করল। 

এর আগে দীর্ঘ সময় ধরে রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলারের নিচে ছিল। গত মে মাসে এ রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন (১০০ কোটিতে এক বিলিয়ন) ডলারের ঘরে নেমে গিয়েছিল।

সূত্র জানায়, গত সোমবার আইএমএফের নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশের অনুক‚লে ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার অনুমোদন করা হয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ছাড় করা হয়েছে ১১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ওই অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ হয়েছে। ফলে রিজার্ভ বেড়ে ২ হাজার ৬২ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। 

এর আগে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের অনুক‚লে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর আগে দুটি কিস্তিতে ১১৬ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। এখন তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ছাড় করা হলো। তিন কিস্তিতে আইএমএফের ঋণ বাবদ বাংলাদেশ পেল ২৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের মূল্যায়ন করতে আগামী নভেম্বরে আইএমএফ মিশন আবার বাংলাদেশে আসবে। শর্ত বাস্তবায়ন ও সংস্কারের অগ্রগতিতে তারা সন্তুষ্ট হলে ডিসেম্বরে চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় হতে পারে। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশকে আরও বেশ কিছু কঠিন শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। 

আইএমএফের ঋণের অর্থ ছাড় করার আগে বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৪৭ কোটি ৩১ লাখ ডলার। এক সপ্তাহ আগে গত ২০ জুন ছিল ১ হাজার ৯৫৩ কোটি ডলার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৬ কোটি ডলার। তবে আইএমএফের কিস্তি যোগ হওয়ায় রিজার্ভ বেড়ে গেছে। 

এদিকে আগামী জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ প্রায় ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। তখন আবার রিজার্ভ কমে যাবে।

দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের চাপে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর অবকাশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থাৎ কর অবকাশ সুবিধা আগের মতোই বহাল থাকছে।

একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্ক আগের মতো শূন্য শতাংশ রাখা হচ্ছে। পৌর এলাকা বা গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে রিটার্ন জমার স্লিপ প্রদর্শন করতে হবে না, তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় ভাড়া নিতে চাইলে স্লিপ প্রদর্শন করতে হবে। আগামী ২৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থবিল-২০২৪ পাশ হবে। সেখানে আয়কর, কাস্টমস সংক্রান্ত এসব পরিবর্তন আসতে পারে। 

গত ২৯ মে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এনবিআর বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের কর অবকাশসহ ৮টি কর সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। ১০ বছর মেয়াদি কর অবকাশ সুবিধা তুলে নেওয়ার ফলে শিল্পভেদে কোম্পানিগুলোর আয়ের ওপর সাধারণ করহার ২০ শতাংশ থেকে ২৭.৫ শতাংশ বা তারও বেশি প্রযোজ্য হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় কারিগরি সহায়তাকারী হিসাবে কর্মরত বিদেশিদের প্রথম তিন বছরের বেতনের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর ছাড় পেত। সেটিও বাতিল করা হয়। এসব অঞ্চলে স্থাপিত কোম্পানির ১০ বছরের জন্য লভ্যাংশ, মূলধনি আয়, রয়্যালটি, টেকনিক্যাল নো-হাউ এবং কারিগরি সহায়তা ফির ওপরও ১০ বছরের কর অব্যাহতি ছিল, এগুলোও বাতিল করা হয়।

অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ বা উন্নয়নের জন্য ডেভেলপার কর্তৃক আমদানিকৃত যন্ত্রপাতির শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে এক শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। শিল্প স্থাপনের মূলধনি যন্ত্রপাতিতেও এক শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বাতিল করা হয়। 

এনবিআর সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে করসুবিধা প্রত্যাহারসহ ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো তুলে ধরেন। ওইদিনই প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী অর্থবিল সংশোধনে কর্মকর্তাদের এসব বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। 

সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিয়ে, জন্মদিন বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে আয়কর রিটার্ন জমার স্লিপ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার কারণে শর্তে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন নিয়মে, শুধু ৮টি সিটি করপোরেশন এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে লাগবে আয়কর রিটার্ন জমার স্লিপ প্রদর্শন করতে হবে। পৌর এলাকা বা গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি সেন্টার বা মিলনায়তনে সামাজিক অনুষ্ঠান করতে ভাড়া নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার স্লিপ প্রদর্শন করতে হবে না।

অবশ্য নানা মহলের সমালোচনার পরও কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুবিধা বহাল রাখা হচ্ছে। ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা ও বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগ থাকছে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারের ক্যাপিটাল গেইনের ওপর কর আরোপের বিধান বহাল রাখা হচ্ছে। ফলে বছরে শেয়ারবাজার থেকে বছরে ৫০ লাখ টাকা বেশি আয় করলে বর্ধিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে গেইন ট্যাক্স দিতে হবে। 

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার ও সুশাসন নিশ্চিতে সংস্কার কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের আর্থিক খাতের ঋণ প্রতিবেদন প্রণয়নে স্বচ্ছতা আরও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে সংস্থাটি অতিমূল্যায়িত বা টাকার মান বেশি বলে মনে করে। এ কারণে টাকার মান বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে ডলারের দাম আরও বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

এদিকে দুর্নীতি কমাতে প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের তালিকা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে তাদের দেওয়া সম্পদের তালিকা প্রতিবছর হালনাগাদ করতেও বলেছে। সংস্থাটি মনে করে, এতে সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে দুর্নীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে।

গত সোমবার রাতে প্রকাশিত আইএমএফের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ডিসেম্বরের মধ্যে আর্থিক খাতের বেশ কিছু শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার ও সুদের হারে যে সংস্কারমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে আইএমএফ সাহসী পদক্ষেপ বলে মনে করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে সব খাতে নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন ব্যবস্থা। এজন্য দ্রুত চলমান সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে আর্থিক খাতে ঋণসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো তৈরি করতে হবে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের করতে হবে। ঋণবিষয়ক যেসব প্রতিবেদন ব্যাংকগুলো তৈরি করে সেগুলোতেও সংস্কার আনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারভিশন ব্যবস্থাও আধুনিকমানের করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে জোর দিয়েছে আইএমএফ।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলেছে, আইএমএফ ঝুঁকিভিত্তিক যেসব কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা বলেছে, সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে থেকেই করছে। ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এখন একে আরও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।  

সূত্র জানায়, বর্তমানে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের নয়। এখানে অনেক ছাড় দিয়ে সংজ্ঞা করা হয়েছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য হলেও তার কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ মাস পর বাংলাদেশে খেলাপি হচ্ছে। এছাড়া ঋণ বিতরণের পর যেসব প্রতিবেদন করা হয় সেগুলোতে যথেষ্ট ফাঁকফোকর রয়েছে। প্রতিবেদন দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ঋণটি কি আদৌ ভালো অবস্থায় আছে নাকি খেলাপির দিকে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান এখনও অতিমূল্যায়িত। অর্থাৎ বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে এর দাম নির্ধারিত হচ্ছে না। এ কারণে তারা ডলারের দাম আরও বাড়ানো ও টাকার মান কমানোর সুপারিশ করেছে। এ লক্ষ্যে বাজারের মৌলিক উপাদানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করতে হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, তারা ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে কাজ করছে। এর অংশ হিসাবেই ক্রলিং পেগ (একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে ওঠানামার সুযোগ দেওয়া) চালু করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো অভ্যস্ত হলেই বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের দিকে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশীয় ব্যাকিং ব্যবস্থার শাসন কাঠামো, স্বচ্ছতা এবং আর্থিক সুস্থতা উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় খেলাপি ঋণ কমানোর রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকে এমডি, পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধিবিধান জারি করেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের শুরু থেকে উচ্চ এবং অস্থির খাদ্যমূল্য, জ্বালানি ও সারের দাম ঊর্ধ্বমুখী এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্র হয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাষ্টিক অর্থনীতিতে বড় চাপের সৃষ্টি হয়েছে। আইএমএফের ঋণ এই চাপকে মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগোতে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। সংস্থাটির ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে যেসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান তার আলোকে অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা করার সুপারিশ করবে আইএমএফ।

২০০২ সালের শুরু থেকে টানা ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৯ বছর আট মাস। ওই সময়ে দেশের শাসনভার ছিল বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে। আলোচ্য সময়ে দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোয় অনেক উত্থানপতন ঘটেছে। তবে একটি সূচক সর্বদাই গড়ে ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সেটি হলো দেশের বৈদেশিক গ্রস মুদ্রার রিজার্ভ। ১০০ কোটি ডলারের কম থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এ নিয়ে সরকারগুলোর মধ্যেও তৃপ্তির ঢেকুর কম ছিল না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার রিজার্ভকে অর্থনৈতিক আলোচনার টেবিল থেকে রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে। তাদের আমলে রিজার্ভ বেশি বাড়ায় গর্ব করে দলের নোতারাও রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তৃতা করতে ভুল করেননি। রিজার্ভ নিয়ে সফলতার গল্প দেশবাসী শুনে অনেকের মধ্যেই একটি আশার বাণী সঞ্চার করেছিল-রিজার্ভ নিয়ে আর ভাবতে হবে না। যে কোনো সংকটে এই রিজার্ভ দিয়ে উতরে যাওয়া যাবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেড় মাসও টিকল না সেই গর্বের জায়গাটি। দ্রুত কমতে থাকল। চার মাসের মাথায় সরকারকে ভাবিয়ে তুলে বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি। সরকার দ্রুত আইএমএফ-এর কাছে ঋণ সহায়তা চায়। এর ধারাবাহিকতায় নিট রিজার্ভ এখন কমে ২ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকারের মধ্যেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রিজার্ভ বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার শেষ মুহূর্তে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ কমে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। পরবর্তী সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে রিজার্ভ সংকটের কারণে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে এক কিস্তির দেনা পরিশোধ স্থগিত করে ঋণ হিসাবে ৩৯ কোটি ডলার নেয় আকুর কাছ থেকে। পরের কিস্তিতে তা পরিশোধ করে।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে রাজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। ২০০১ সালের শেষদিকে গ্রস রিজার্ভ ছিল ১৩০ কোটি ডলার। ২০০৬ সালে দলটি ক্ষমতা ছাড়ার সময় রিজার্ভ ছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। রিজার্ভ বেড়েছিল ২ দশমিক ৬৮ গুণ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে রিজার্ভ বাড়িয়েছে। ২০০৮ সালে তারা ৭০০ কোটি ডলার রিজার্ভ রেখে যায়। ওই দুই বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ২ গুণের বেশি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে রিজার্ভ বাড়ানোর জোরালো পদক্ষেপ নেয়। তাদের সময়ে ২০১০ সালের জুনে রিজার্ভ প্রথম এক হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করে। ২০১৪ সালের জুনে ২ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করে। ২০১৬ সালের জুনে ৩ হাজার কোটি ডলার এবং ২০২০ সালের অক্টোবরে ৪ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করে। ২০২১ সালের আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ। আওয়ামী লীগ সরকারের ওই ১৩ বছরে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। রিজার্ভ বাড়ায় সরকারের পক্ষ থেকে অনেক গর্ব করা হয়। তীব্র সমালোচনাকে উপেক্ষা করে রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়। এরপর থেকেই রিজার্ভ কমতে থাকে। তবে তা কমছিল খুবই ধীরগতিতে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিকভাবে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এতে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে থাকে। ফলে ডলার খরচ বেড়ে যায়। চাপে পড়ে ডলার। এর দাম বাড়তে থাকে। ওই মাসে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ ছয় মাসে রিজার্ভ কমেছিল ২১১ কোটি ডলার। বৈশ্বিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ায় ওই বছরের মার্চে ৯৫১ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। যে কারণে রিজার্ভ আরও চাপে পড়ে যায়। এ চাপ কমাতে এবং রিজার্ভ সাশ্রয় করতে ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন আরোপ করে। এতেও রিজার্ভের নিম্নগতি রোধ করা সম্ভব না হলে এক মাসের মাথায় এলসি মার্জিন আরও বাড়িয়ে দেয়। ১০ মে থেকে বিলাসী পণ্যে ৭৫ শতাংশ ও বাণিজ্যিক পণ্যে ৫০ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। এর ৫৫ দিনের মাথায় ৫ জুলাই বিলাসী পণ্যে শতভাগ মার্জিন আরোপ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে ঋণ বন্ধ করে দেয়। ওই বছরের জুলাইয়ে রিজার্ভ নেমে আসে ৩ হাজার ৯৬০ কোটি ডলারে। ৫ মাসে রিজার্ভ কমে যায় ৬৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ গর্বের রিজার্ভ টিকল না চার মাস। এর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের রিজার্ভ ঝুঁকিতে চলে যায়। এখনো রিজার্ভ নিম্নমুখী। গত ১২ জুন গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৫২ কোটি ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৯২১ কোটি ডলার। প্রায় তিন বছরে দেশের গ্রস রিজার্ভ কমেছে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি ডলার।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিজার্ভ হচ্ছে বিপদে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু রিজার্ভ বাড়ায় সরকার এর অপব্যবহার শুরু করে। একদিকে অপব্যবহার করে রিজার্ভ ক্ষয় করেছে, অন্যদিকে এসেছে মন্দা। এ দুইয়ে মিলে রিজার্ভ সংকট প্রকট হয়েছে। রিজার্ভ ভালো থাকলে ডলারের দাম এত বাড়ত না। পণ্যের দামও এত আকাশচুম্বী হতো না। মূল্যস্ফীতিও হতো না এত ঊর্ধ্বমুখী। এখন যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশ, এর সূত্রপাত হচ্ছে সুশাসনের অভাব এবং রিজার্ভ সংকট থেকে। এছাড়া বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবও রয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে সরকার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আইএমএফ-এর ঋণ চায়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে দুটি কিস্তিতে ১১৬ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এতে রিজার্ভের বেশি উন্নতি হয়নি। তবে সাময়িক উপশম হয়েছে। ২৫ বা ২৬ জুন তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৫ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে।

রেকর্ড রিজার্ভ দিয়ে ওই সময়ে প্রায় ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। কিন্তু তা তিন মাসের মধ্যেই কেন ঝুঁকির পর্যায়ে নেমে গেল, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আইএমএফও সরকারের রিজার্ভের ওই হিসাব মানতে নারাজ। তারা বারবার নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি করেনি দীর্ঘ সময়। গত বছরের জুলাই থেকে নিট হিসাব প্রকাশ করলেও এটিও আইএমএফ মানতে নারাজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৯২১ কোটি ডলার। কিন্তু আইএমএফ মনে করে এ থেকে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক দেনা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বাদ দিতে হবে। এগুলো বাদ দিলে নিট রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের মতো। ওই সময়ে রিজার্ভের হিসাব বাড়িয়ে দেখানো হলেও নিট রিজার্ভ কম ছিল। যে কারণে রিজার্ভ কমতে থাকায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে সরকারের মধ্যেও রিজার্ভ নিয়ে অস্থিরতা বাড়ছিল। সরকার এখনো অস্থির। রিজার্ভ বাড়াতে এখন বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট দেশের ৬ কোটি শ্রমিকের নিত্যদিনের অভাব-অনটন আরও বাড়াবে বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।

শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সংবাদ সম্মেলনে বাজেট প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে এসব মন্তব্য করেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল।

তিনি বলেন, জাতীয় বাজেটে শ্রমিক উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ এবং শ্রমিকদের জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু না করার প্রতিবাদে কর্মসূচি দেওয়া হবে।  এ সময় শ্রমিকদের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান তারা।

লিখিত বক্তৃতায় অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা ৬ কোটি শ্রমিকের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। 

শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সরকারের অর্থ ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে এবং জাতীয় সংসদে ৮ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে। সরকার শ্রমিকদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে না এবং ক্ষমতার রাজনীতির জন্য তাদের শুধুমাত্র ভোটার হিসেবে ব্যবহার করে। এই বাজেট ৬ কোটি শ্রমিকের অভাব-অনটন আরও বাড়াবে এবং তাদেরকে আরও দরিদ্র করে তুলবে। এই বাজেটে শ্রমিকদের প্রতি অবিচার হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং সকল শ্রমিক সংগঠন, গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক শক্তি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, জিডিপির উন্নয়নের সূচক ৫.৭ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ৩ লাখ ৬ হাজার ১৪৪ টাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ পোশাক শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড ৫ জন শ্রমিক পরিবারের জন্য ১২,৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা একজন শ্রমিকের মাসিক আয় মাত্র ২৫০০ টাকা দাঁড়ায়। এই বৈষম্যমূলক আয় নির্ধারণ শ্রমিকদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।

মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১৪ কোটি মানুষের নিজস্ব আবাসন নেই এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সম্পদ ও খাদ্য বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বাসা ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ফলে শ্রমিক পরিবারগুলো দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে।
সরকারি ১৪ লাখ কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতার বরাদ্দ ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। অথচ শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর কোনো পদক্ষেপ নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য ৩০ কেজি চাল, ২০ কেজি আটা, ৫ কেজি চিনি, ৫ লিটার তেল রেশনিং চালু করলে বছরে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

এছাড়া আগামী ২৫ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের প্রতিটি শিল্প অঞ্চলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, গ্রিন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সুলতানা আক্তার, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক টিইউস’র আইন বিষয়ক সম্পাদক কেএম মিন্টু, বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এফএম আবু সাঈদ, টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হোসেন প্রমুখ।

মার্কিন চিপ জায়ান্ট এনভিডিয়ার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানির খেতাব হারানোর দুই দিন পরই তা পুনরুদ্ধার করেছে সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফট।

গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে এনভিডিয়ার শেয়ারমূল্য সাড়ে তিন শতাংশ কমে যাওয়ার পরপরই তালিকার শীর্ষস্থান থেকে ছিটকে পড়ে এই চিপ নির্মাতা। এর ফলে কোম্পানিটির বাজারমূল্য কমে এসেছে তিন লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে। একই দিনে মাইক্রোসফটের শেয়ারে কিছুটা দরপতন দেখা গেলেও তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার বাজারমূল্য নিয়ে দিন শেষ করে কোম্পানিটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানি হওয়ার ‘মিউজিক্যাল চেয়ারে’ এখন লড়াই করছে এনভিডিয়া, মাইক্রোসফট ও অ্যাপল। এমনকি তারা বিশ্বের প্রথম কোম্পানি হিসেবে চার ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছার লক্ষ্যও নিয়েছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় শেয়ারবাজারে বড় উত্থান দেখেছে এনভিডিয়া, যেখানে বেশিরভাগ কৃতিত্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পণ্য বিকাশে কোম্পানির প্রাথমিক বিনিয়োগের।

মঙ্গলবার শেয়ারবাজারে মাইক্রোসফটকে সরিয়ে শীর্ষে চলে যায় এনভিডিয়া, যেখানে ২০২২ সালের পর থেকে নিজেদের শেয়ারমূল্য ১০ গুণ বেড়েছে কোম্পানিটির। ফলে সেদিন কোম্পানির বাজারমূল্য তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

কেউ কেউ ধারণা প্রকাশ করেছেন, এরপর থেকে কোম্পানিটি ওপরের দিকেই যেতে থাকবে। তবে আরেক অংশ প্রশ্ন তুলেছে, এতে কোম্পানিটিকে সম্ভবত অতিমূল্যায়িত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এনভিডিয়া এআই খাতে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে পারে কিনা, বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য তাদের শেয়ারে প্রভাব পড়বে কিনা। কারণ এ খাতের লাগাম নিজেদের হাতে নিতে এরই মধ্যে প্রচুর বিনিয়োগ করছে কোম্পানিগুলো।

মার্কিন বিনিয়োগকারী ব্যাংক ডিএ ডেভিডসনের বিশ্লেষক জিল লুরিয়ার মতে, এ বিষয়ে এনভিডিয়ার সতর্কতা এসেছে দীর্ঘমেয়াদি এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এ ধরনের পারফরম্যান্স বজায় রাখা খুবই জটিল বিষয়।

বাংলাদেশকে ৯০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা দেশীয় মুদ্রায় ১০ হাজার ৫৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।জলবায়ু সহিষ্ণু ও টেকসই প্রবৃদ্ধি, শহরাঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আর্থিক পরিস্থিতি এবং আর্থিক খাতে নীতিমালা জোরাল করতে এ ঋণ দেওয়া হয়েছে। 

শনিবার বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গতকাল (শুক্রবার) এই ঋণের অনুমোদন দেয় বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের বোর্ড। 

বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ও ভুটানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্য সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করবে। তিনি আরও বলেন, নতুন এই অর্থায়ন বাংলাদেশকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। একটি হচ্ছে, আর্থিক খাত ও নগর ব্যবস্থাপনা এবং অন্যটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে।

বিজ্ঞপ্তিতে একটি প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, দুই কিস্তি ঋণের শেষ কিস্তি হিসেবে ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সংস্কারের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের গতি বাড়াবে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনসহ ভবিষ্যতে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা করবে। এ ছাড়া অন্য একটি প্রকল্পে দেওয়া হচ্ছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট এবং এই প্রোগ্রামের টাস্ক টিম লিডার বার্নার্ড হ্যাভেন এক বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ সরকার বাহ্যিক ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলায় শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংস্কার এবং আর্থিক খাত শক্তিশালী করার জন্য একটি নতুন আইনি কাঠামো গ্রহণ করেছে, যা ব্যাংক পুনরুদ্ধার কাঠামোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। কম মূলধনী ব্যাংকগুলো সমস্যা মোকাবিলার জন্য একটি দ্রুত সংশোধনমূলক কর্মকাঠামো বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করবে। এটি অর্থনৈতিক মন্দা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের রক্ষা করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিও শক্তিশালী করবে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আমানত কমছে ৫৯৭ কোটি টাকা। আগের বছরে আমানত তুলে নেওয়ার অঙ্ক ছিল সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য প্রকাশ হলে প্রশ্ন উঠেছে এ অর্থের নতুন গন্তব্য কোথায়। কোন কারণে তুলে নেওয়া হচ্ছে বিপুল অঙ্কের আমানত, সুইস ব্যাংকের আকর্ষণই বা কমছে কেন। তবে ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনের অগ্রগতির কারণে পাচারের অর্থ এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছুটছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কেওয়াইসি হাব’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও সিঙ্গাপুরে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারের অর্থ এসব দেশে প্রবেশ করছে। তবে এর মধ্যে মানি লন্ডারিংয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রে। মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় ঝুঁকি বেড়েছে এমন দশটি দেশ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-হাইতি, চাদ, মিয়ানমার, দ্য ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এবং রিপাবলিক অব কঙ্গো, মোজাম্বিক, গাবন, লাওস, ভেনিজুয়েলা ও গিনি বিসাউ।

অর্থনীতিবিদ ও অর্থ পাচারসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে বিকল্প গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছে পাচারের অর্থ। যেখানে শুধু ব্যাংকে টাকা রাখাই নয়, সংশ্লিষ্ট দেশের পাসপোর্ট প্রাপ্তি, সম্পদের (বাড়ি-ঘর) মালিকানা অর্জন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় সুবিধা দেওয়া হয়। স্মার্ট অর্থ পাচারকারীরা এখন টাকা শুধু ব্যাংকে ফেলে রাখছে না। এসব অর্থের বিনিময়ে গড়ে তুলছে বিনিয়োগের সাম্রাজ্য। সংশ্লিষ্টদের মতে, সুইস ব্যাংকে তিন শ্রেণির লোক আমানত রাখেন। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, পাসপোর্ট হোল্ডার যারা বিদেশে থাকে বা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। এছাড়া দেশ থেকে অর্থ পাচারকারী যারা নিজেদের তথ্য গোপন রাখতে সেখানে অর্থ জমা করেন।

সুইস ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের আমানতকারীদের টাকার অঙ্ক ৫৬ কোটি ২৯ লাখ থেকে লাফ দিয়ে ২০২১ সালে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়ায়। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় শীর্ষ আমানতকারী দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। এরপর ২০২২ সালে অস্বাভাবিক গতিতে কমে আমানত দাঁড়ায় ৫ কোটি ৫২ লাখ ফ্রাঁতে। আর ২০২৩ সালে নেমে আসে ১ কোটি ৭৭ লাখে।

ধারণা করা হচ্ছে, অর্থ পাচারকারীদের কাছে কয়েকটি কারণে সুইস ব্যাংকের আকর্ষণ কমছে। প্রথম আন্তর্জাতিক চাপে সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর দেশ ভিত্তিক আমানতের হিসাব প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে যারা সত্যিকার অর্থে পাচারকৃত টাকার তথ্য গোপন রাখতে চায় তারা এখন সুইস ব্যাংককে প্রাধান্য দিচ্ছে না। দ্বিতীয় হচ্ছে সুইস ব্যাংকের প্রতিযোগী দেশগুলো আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে পাচারের অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে যে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলা ও সম্পদের (ঘরবাড়ি) মালিকানা অর্জনের সুবিধা আছে সেখানে চলে যাচ্ছে। এ ধরনের অনেক কোম্পানি দুবাই ও নিউইয়র্কে সন্ধান মিলবে। অনেক দেশে পাচারকৃত অর্থের কর দিতে হয় না, অর্থ ব্যয় করলে সহজে সংশ্লিষ্ট দেশের পাসপোর্ট মেলে এবং সম্পদের মালিক হওয়া যায়। ফলে সুইস ব্যাংকের তুলনায় অন্যান্য দেশ ও গন্তব্যগুলো আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে পাচারকারীদের কাছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচারের অর্থ সরিয়ে নেওয়া সহজ হয়ে উঠছে। এসব কারণে আকর্ষণ কমছে সুইস ব্যাংকের।

জানতে চাইলে অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, সুইস ব্যাংকের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাখা আছে। ফলে যে কোনো দেশে সুইস ব্যাংকের শাখায় বাংলাদেশি কোনো ব্যক্তি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করলে সেটি কেন্দ্রীয় ভাবে সুইস ব্যাংকের হিসাবে গণনায় আসে। কোনো বাংলাদেশি সুইস ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সেটি তাদের এসেটে দেখাবে। রপ্তানি সময় হিসাব নিষ্পত্তি না হলে সেগুলো সুইস ব্যাংকের নষ্ট অ্যাকাউন্টে দেখানো হয়। তবে সুইস ব্যাংকের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো তথ্য দেয় না। এখন আমানত কমে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। তার মতে, পাচারকৃত অর্থ সেখান থেকে বের করে নেওয়া হলেও সেটি বোঝার উপায় থাকবে না। কারণ অন্য দেশগুলোতে নেওয়া হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিশেষ করে একজন ব্যক্তি আমেরিকায় একটি ব্যবসা করে বছরে এক লাখ ডলার মুনাফা করেন। কিন্তু আয়কর দেওয়ার সময় মুনাফা দেখানো হলো ২০ লাখ ডলার। বাকি ১৯ লাখ ডলার সে দেশে প্রবশে করলেও ধরার উপায় থাকছে না।

এদিকে অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং শুধু বাংলাদেশ নয় এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। এটি বিশ্বব্যাপী হুমকি হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধ সংক্রান্ত কার্যালয় (ইউএনওডিসি) অনুসারে প্রতিবছর বিশ্বে পাচার হচ্ছে ৭৬ হাজার ৪৭২ কোটি ডলার। এটি প্রতিবছর বৈশ্বিক জিডিপির ২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের সমান। যে কারণে মানি লন্ডারিং বিরোধী কার্যক্রম আরও চাপের মধ্যে পড়েছে। পাশাপাশি ডিজিটালাইশেনের কারণেও বেড়েছে অর্থ পাচারের ঘটনা। কেওইসির প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ পাচারের বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ ২০২৪ সালের মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী অর্থায়ন এবং বিস্তার অর্থায়নের জাতীয় ঝুঁকি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে অবৈধ আর্থিক হুমকি, দুর্বলতা এবং ঝুঁকিগুলো তুলে ধরা হয়। সেখানে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালে ১৪ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

দ্বিতীয় অর্থ পাচারের দেশ যুক্তরাজ্য। মাদক পাচারের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনায় শীর্ষ রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কানাডায়ও বেড়েছে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা। সেখানে রিয়েল এস্টেট খাতে বেশি আসছে পাচারকৃত অর্থ। একই ভাবে জার্মানি ও সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে বাংলাদেশেও মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা বেড়েই চলছে। গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) তুলনায় চলতি বছরে (২০২৩-২৪) পাচারের ঘটনা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মূলত ব্যাংক লেনদেন, হুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংক এবং গেমিং বেটিংয়ের মাধ্যমেই এসব ঘটনা ঘটছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সন্দেহে প্রায় সাড়ে ৫শ ব্যাংক হিসাব শনাক্ত করা হয়। সেখানে লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনার জন্য যৌথভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিআইএফইউ) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে বিনিময় করা হয়। এর আগের অর্থবছরে ২৮৫টি ঘটনার তথ্য বিনিময় হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আরও প্রায় ১১ হাজার লেনদেনকে সন্দেহজনক তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগে ব্যক্তিগত ২৭ হাজার ৬৮০ মোবাইল ব্যাংক (এমএফএস) স্থগিত এবং ৫ হাজার ২৯টি এমএফএস এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে।

সূত্রমতে, পাচার হয়ে যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬৫টি চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, আমরা আইনি প্রক্রিয়া মেনে সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিঠি দিয়েছি। একইভাবে আমাদের কাছেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে। এরই মধ্যে পাচারকৃত অর্থের তথ্য চেয়ে ১৫টি দেশ বাংলাদেশকে অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে। আর অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়নের তথ্যাদি চেয়ে এরই মধ্যে বিশ্বের ৬৫টি দেশ থেকে অনুরোধপত্র এসেছে।

অনেক দেশেই অর্থ পাচার করা হচ্ছে

অধ্যাপক মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, নানা কারণে সুইস ব্যাংকের আকর্ষণ কমছে। এখন ঝামেলা ছাড়া নিরাপদে বিশ্বের অনেক দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা যায়। অর্থ পাচার আগের তুলনায় আরও সহজ হয়েছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পাচারকারীরা আগের তুলনায় আরও বেশি সুবিধা নিতে পারছে। ফলে পাচারকারীরা এখন সুইস ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে ইউএসএ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সুইস ব্যাংক আগের মতো কঠোর নিয়মে চলছে না। তারা এখন বিভিন্ন দেশকে তথ্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে যারা এক সময় পাচারকৃত অর্থ গোপনে রাখার জন্য সুইস ব্যাংককে নিরাপদ মনে করছে তারা এখন সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে সুইস ব্যাংকে আগের মতো আমানত বাড়ছে না।

তথ্য গোপন না থাকায় আকর্ষণ কমছে

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন জানান, তিন শ্রেণির লোক সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে। প্রথম হচ্ছে সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থও সেখানে রাখা হয়। দ্বিতীয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, পাসপোর্ট হোল্ডার যারা বিদেশে থাকে বা বাণিজ্য করছে তারাও সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে। এরা রাখে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। আর তৃতীয় হচ্ছে দেশ থেকে অর্থ পাচারকারী। যারা নিজেদের গোপন রাখতে সেখানে অর্থ জমা করে। তবে সম্প্রতি সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সে ধরনের গোপনীয়তা রাখছে না। কোনো দেশের সরকার চাইলে তথ্য দিয়ে দিচ্ছে ব্যাংকটি। ফলে যারা সত্যিকার অর্থে পাচারকৃত টাকার তথ্য গোপন রাখতে চায় তারা এখন সেখানে রাখছে না।

তিনি আরও বলেন, পাচারকারীরা বিদেশে দুভাবে অর্থ ব্যবস্থাপনা করে। এক শ্রেণি দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলে। দুবাই ও নিউইয়র্কে এ ধরনের অনেক কোম্পানির সন্ধান মিলবে। ওইসব পাচারকারী ব্যাংকে বেশি টাকা রাখে না। দ্বিতীয় হচ্ছে ব্যাংকে টাকা না রেখে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বাড়িঘর ও স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করছে। এসব কারণে সুইস ব্যাংকে কোনো গুরুত্ব নেই। এছাড়া দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সুইস ব্যাংকে সরকারের ডিপোজিটও কমে আসছে। আগে পাচারকৃত অর্থ ব্যাংকে রেখে চলে আসত। এখন পাচারকৃত অর্থ ব্যবহারের বিকল্প অনেক উৎস তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখার প্রবণতা কমছে।

অর্থ গোপনের সুবিধা আছে নানা দেশে

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশন অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতে, আগের তুলনায় সুইস ব্যাংক বেশি নিয়মকানুন মানার চেষ্টাসহ তথ্য প্রকাশ করছে। নানা কারণে এ ব্যাংকে টাকা রাখার বিষয়টি নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের অনেক দেশে এখন সুইস ব্যাংকের মতো অর্থ রাখার সুবিধা আছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ অনেক দেশে পাচারকৃত অর্থকে স্বাগত জানার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, ওইসব দেশে পাচারকৃত অর্থ দ্বারা সম্পদের মালিকানা অর্জন করা যাচ্ছে। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে মালয়েশিয়া, হংকং ও সিঙ্গাপুর। আরও আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে আরব আমিরাত। অর্থাৎ আগে সুইস ব্যাংকের একটি মনোপলি ব্যবসা ছিল সেটি ভেঙে গেছে। কারণ বিকল্প হিসাবে অন্য দেশগুলো প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে। ওইসব দেশের সুযোগ-সুবিধা আমাদের দেশের অর্থ পাচারকারীরা নিচ্ছে বলে মনে করি। সুইস ব্যাংকে আমানত কমেছে এর মানে দেশ থেকে অর্থ পাচার কমেছে সেটি বলা যাবে না। বরং দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়েছে।

তিনি আরও বলেন, অনেক দেশে পাচারকৃত অর্থের কর দিতে হয় না। আবার নতুন দেশ যুক্ত হয়েছে যেমন গ্রিস ও পর্তুগাল-এ ধরনের দেশগুলো আছে এই তালিকায় কিন্তু তাদের নাম আসছে না। যেসব দেশে অর্থ ব্যয় করলে সহজে সংশ্লিষ্ট দেশের পাসপোর্ট মেলে এবং সম্পদের মালিক হওয়া যায়। ফলে সুইস ব্যাংকের তুলনায় অন্যান্য দেশ ও গন্তব্যগুলো আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে পাচারকারীদের কাছে। যে কারণে আকর্ষণ সুইস ব্যাংকের। সুইস ব্যাংক এখন তথ্য প্রকাশ করছে, আগের মতো কড়াকড়ি নেই। এছাড়া প্রতিযোগিতায় থাকা কাছাকাছি দেশগুলো যেমন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশে যেখানে যাওয়া আসা ও সম্পদ অর্জন এখন সহজ। এসব দেশ সুযোগগুলো করে দিচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের স্মার্ট অর্থ পাচারকারীরা সুযোগগুলো নিচ্ছে। এছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় শুধু অর্থ পাচার নয়, বাড়িঘরে মালিকানা নিচ্ছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি কাঠামো আগের তুলনায় অনেক সক্রিয় হয়েছে। সরকারের সদ্দিচ্ছা থাকলে পাচারকৃত অর্থ শনাক্ত, ফেরত আনা এবং পাচারের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা অবশ্য সম্ভব।

চিঠি দিলেই সুইস ব্যাংক বা অন্য কোনো দেশ পাচারের তথ্য দেবে এটি ঠিক নয়। এটি ফাঁকা আওয়াজের মতো। কি প্রক্রিয়ায় চিঠি দেওয়া হচ্ছে, আইন অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা এসব বিষয় সরকারের পক্ষ থেকে খোলাসা করে বলা হয় না।

দীর্ঘ সময় ধরে সংকটের কারণে ডলারের বিপরীতে বাস্তবে বা বাজারে টাকার মান কমে যাচ্ছে। আগামীতে আরও কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে কাগজে-কলমে বা প্রকৃত বিনিময় হারের হিসাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেড়েই চলেছে। 

গত সোয়া দুই বছরে ডলারের বিপরীতে বাস্তবে টাকার মান কমেছে ৩৭ দশমিক ২১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ। অথচ ওই সময়ে প্রকৃত বিনিময় হারে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেনি। বরং বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যদিও বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। একই সঙ্গে প্রকৃত ও সাধারণ বিনিময় হারের মধ্যেকার ব্যবধানও অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

ডলারের দামে এই ধরনের আচরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষকদের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরাও রীতিমতো অবাক। তাদের মতে, এমনটি হওয়ার কথা নয়। তারা এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য নিবিড়ভাবে গবেষণার আহ্বান জানিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝতে প্রকৃত বিনিময় হার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে কেন এমন মিসম্যাচ বা সমস্যা হলো? তা খতিয়ে দেখা উচিত। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলোতে কোনো সমস্যা হওয়ায় এমনটি হয়ে থাকতে পারে।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ফেব্র“য়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিকভাবে পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। ফলে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে ডলারের সংকট দেখা দেয়। এরপর থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। 

দেশে ডলারের দাম দুইভাবে নির্ধারিত হয়। একটি হচ্ছে সাধারণ বা নমিনাল দর। এটি বাজারে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করে। এই দরেই বাজারে ডলার বেচাকেনা হয়।

অপরটি হচ্ছে রিয়েল এক্সচেঞ্জ রেট বা প্রকৃত বিনিময় হার। এটি বাংলাদেশের যেসব দেশের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক সম্পর্কে বেশি ওইসব দেশের মুদ্রাগুলো নিয়ে একটি বাস্কেট বা ঝুড়ি তৈরি করা হয়। এসব দেশের মুদ্রার বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির হার, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বিশ্লেষণ করে প্রকৃত বিনিময় হার তৈরি করা হয়। তবে প্রকৃত বিনিময় হারটি বাজারে প্রয়োগ করা হয় না। এটি প্রতিযোগী বা বাংলাদেশের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে এমন দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান জানার জন্য তৈরি করা হয়। বর্তমানে ১৫টি দেশের মুদ্রা নিয়ে একটি বাস্কেট তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ। 

সাধারণত ডলারের প্রকৃত বিনিময় হারের চেয়ে বাজার দর ৬ থেকে ১০ টাকা বেশি থাকে। রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো উৎসাহিত করতে ডলারের দাম প্রকৃত বিনিময় হারের চেয়ে বাজার দর একটু বেশি রাখা হয়। এর মাধ্যমে রপ্তানিকারক ও রেমিটরদের কারেন্সি বেনিফিট বা মদ্র্রা বিনিময় হারের সুবিধা দেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, করোনার বেশ আগে থেকে এ সমস্যাটি হয়েছে। অর্থনীতির কোনো সূচকে গোলমাল হয়েছে হয়তো, যে কারণে বিনিময় হারে এমন বৈপরীত্য পাওয়া গেছে। তবে এখন দুই হারের মধ্যকার ব্যবধান বেশি মাত্রায় বেড়ে গেছে। এত বাড়াটা ঠিক হচ্ছে না। এখন ডলার সংকটের কারণেও এমনটি হতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাজারে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৮ টাকায়। তবে এই দামে ব্যাংকে ডলার পাওয়া যায় না। আমদানিতে ১২৫ টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে। আগাম কিনলে প্রতি ডলার লাগছে ১৩০ টাকা। আমদানির বেশিরভাগ ডলারই এখন আগাম কেনা হচ্ছে। ফলে ওই সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে গড়ে ৩২ টাকা থেকে ৪৪ টাকা। এ হিসাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৩৭ দশমিক ২১ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশ। 

একই সময়ের ব্যবধানে প্রকৃত বিনিময় হারের হিসাবেও ডলারের দাম বাড়ার ও টাকার মান কমার কথা। কিন্তু সেটি হয়নি। হয়েছে উলটোটি। ওই সময়ে ডলারের দাম কমেছে, বেড়েছে টাকার মান। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকৃত বিনিময় হারে ডলারের দাম ছিল ১১৪ টাকা ৬৪ পয়সা। মে মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০৭ টাকা ০৮ পয়সা। আলোচ্য সময়ে ডলারের দাম কমেছে ৭ টাকা ৫৬ পয়সা। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই।

ডলারের প্রকৃত ও সাধারণ বিনিময় হারের মধ্যকার বৈপরীত্য শুরু হয় করোনার আগে থেকে। ওই সময়ে বাজার দরের চেয়ে প্রকৃত বিনিময় হারের দর বাড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারিতে বাজার দর যেখানে ৮৬ টাকা ছিল, সেখানে প্রকৃত বিনিময় হার ছিল ১১৪ টাকা ৬৪ পয়সা। বাজার দরের চেয়ে প্রকৃত বিনিময় হার বেশি ছিল ২৮ টাকা ৬৪ পয়সা। এটিকে একেবারেই অস্বাভাবিক মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষকরা। বাজার দরের চেয়ে প্রকৃত বিনিময় হারের দর কম হওয়া উচিত ছিল। একই বছরের মার্চে প্রকৃত বিনিময় হার আরও বেড়ে ১১৫ টাকা ৪৯ পয়সা ওঠে। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষকরা বিনিময় হারের এই বৈপরীত্য নিয়ে কাজ করে অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে কিছু বৈষম্য দেখতে পান। পরে এগুলো পর্যায়ক্রমে ঠিক করা হয়। এর পর থেকে প্রকৃত বিনিময় হারের দাম কমতে থাকে এবং বাজারে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। 

এর আগে প্রতি বছরই বাজার দরে টাকার মান কিছুটা কমলেও ২০২০ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিছুটা বেড়েছে। কারণ ওই বছরে আমদানি কম ছিল, ডলারের প্রবাহ বেশি ছিল। যে কারণে টাকার মান সামান্য বেড়েছিল।

২০২২ সালের মার্চ থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। ওই মাসে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা, ২০২৩ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৬ টাকা ৮০ পয়সায়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ টাকা ৫০ পয়সায়। ডিসেম্বরে আবার ১১০ টাকায় নামে। এরপর থেকে ৮ মে পর্যন্ত ১১০ টাকায় স্থির ছিল। ৯ মে থেকে ডলারের দাম আবার বেড়ে ১১৮ টাকায় ওঠে।

একই সঙ্গে প্রকৃত বিনিময় হারে ডলারের দাম কমতে থাকে। ২০২৩ সালের মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ১০২ টাকা ৬৫ পয়সা। সেপ্টেম্বরে আবার সামান্য বেড়ে ১০৬ টাকা ৫৭ পয়সায় ওঠে। ডিসেম্বরে আবার ১০২ টাকা ৪২ পয়সায় নেমে যায়। এ বছরের শুরু থেকে আবার এর দাম বাড়তে থাকে। মে পর্যন্ত ধীরে ধীরে বেড়ে ১০৭ টাকা ০৮ পয়সা দাঁড়িয়েছে।

২০২৩ সালের মার্চ থেকে বিনিময় হারে বৈপরীত্য দূর হতে থাকে, এখন অনেকটা স্বাভাবিক ধারায় ফিরছে। মে মাসে বাজারে ডলারের দাম ১১৮ থেকে ১৩০ টাকা। প্রকৃত বিনিময় হারে দাম ১০৭ টাকা ০৮ পয়সা। এ হিসাবে দুই ধরের মধ্যকার ব্যবধান হচ্ছে ১১ থেকে ২৩ টাকা। ব্যবধান এত বেশি হওয়াটাও যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ টাকা বেশি অবমূল্যায়িত হলে আমদানি ব্যয়সহ বৈদেশিক দায় বেড়ে যাবে।

সারা বিশ্বে ২০২৩ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পৌনে ২ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের কমেছে পৌনে ১৪ শতাংশ। ফলে টানা তিন বছর বৃদ্ধির পর দেশে এফডিআই আসা কমল। গত বছর বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা দেশি মুদ্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)। ২০২২ সালে এফডিআই এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলারের।

নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি এফডিআই স্টক বা মোট বিনিয়োগের স্থিতিও কমে গেছে। গত বছর বিনিয়োগের স্থিতি কমে ২ হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলারে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআই প্রাপ্তিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সামগ্রিকভাবে গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় এফডিআই প্রবাহ ১৭ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে বাংলাদেশের উল্টো কমেছে। ৪৫টি এলডিসির পাওয়া মোট এফডিআইয়ের ৫০ শতাংশই পেয়েছে পাঁচটি দেশ। এর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ, গত বছরও তা–ই ছিল। শীর্ষ দুই দেশ হচ্ছে ইথিওপিয়া ও কম্বোডিয়া। আর চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে সেনেগাল ও মোজাম্বিক।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের চলতি বছরের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আঙ্কটাড।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে। ২০২০ সালে মহামারির সময় এফডিআই ২৫৮ কোটি ডলারে নামে। ২০২১ সালে আবার বাড়ে, যা পরের বছরও বজায় থাকে। ২০২১ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল ২৮৯ কোটি ডলার।

বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগ যেমন কমেছে, তেমনি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের দেশের বাইরে বিনিয়োগও গত বছর কমেছে। গত বছর বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ডলারের বিনিয়োগ বিদেশে গেছে। তার আগের বছর বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছিল ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে সামগ্রিকভাবে এফডিআই প্রবাহ পৌনে ২ শতাংশ কমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির শ্লথগতি ও ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির কারণে এফডিআই প্রবাহ কমেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

সংস্থাটির মতে, উন্নত দেশগুলোতে গত বছর এফডিআই প্রবাহ ৯ শতাংশ বেড়েছে। ৪৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে উন্নত দেশগুলো। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এফডিআই কমেছে ৭ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলো সম্মিলিতভাবে গত বছর ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে।

আঙ্কটাড বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গত বছরের তুলনায় গ্রিনফিল্ড বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এসব দেশে ৮ হাজার প্রকল্পে ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলার গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের ঘোষণা রয়েছে। যদিও উন্নত দেশে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা কিছুটা কমেছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় গত বছর সার্বিকভাবে এফডিআই কমেছে ৩৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ভারত ২ হাজার ৮১৬ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ কম। পাকিস্তানে এফডিআই গেছে ১৮২ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ২৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায়ও এফডিআই কমেছে। তবে নেপাল ও মালদ্বীপে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। প্রথমত, নতুন বিনিয়োগ কমেছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ স্থিতিও কমেছে। বহু বছর ধরে আমরা সেভাবে নতুন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছি না। বিদেশি যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে হারাচ্ছি। এটা আমাদের জন্য একটা বার্তা।’

মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, ‘বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হয়েছে খুবই সামান্য। আইনকানুনের প্রয়োগ খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নীতির ধারাবাহিকতা চায়। নতুন দেশে বিনিয়োগের সুরক্ষা দেখে। এসব জায়গায় আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে একটা নীতিকৌশল ও তার বাস্তবায়ন দরকার। কিন্তু তা নেই। সব মিলিয়েই আমরা পিছিয়ে আছি।’

সম্পাদক ও প্রকাশক : মঈনুদ্দিন কাজল
deshermatidaily@gmail.com
০১৬১৫১১২২৬৬, ০১৬৭৩৫৬২৭১৬

দেশের মাটি কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।